আমার প্রিয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ কোনো সন্দর্ভ রচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, সে যোগ্যতাও আমার নেই। এ শুধু একজন সাংবাদিক হিসেবে কিছু স্মৃতিচারণা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন।
তাঁর প্রাঞ্জল বাচনভঙ্গিতে নীরস গদ্যও সরস হয়ে উঠত। অত্যন্ত সহজ, সরস, পরিচ্ছন্ন বক্তৃতায় পাঠ্যবিষয়টি উপস্থাপন করার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। স্বল্পভাষী এই শিক্ষক শিক্ষকতার বাইরেও কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গেলে একইভাবে অত্যন্ত প্রাঞ্জল গদ্যে সংক্ষিপ্তভাবেই তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করতেন, অযথা বাক্য ব্যয় করে কালক্ষেপণ করতেন না।
আমার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী ছাত্র ছিল তাঁর, কিন্তু কেন জানি না আমার প্রতি তাঁর একটু অন্য রকম স্নেহ ছিল। মনে পড়ে, আমি তখন কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের উপপরিচালক। স্যার লোক পাঠালেন আমার কাছে—মধুর ক্যানটিনখ্যাত মধুদার ওপর একটি সংকলন বের হবে, তাতে আমাকে একটি লেখা দিতে হবে। বলা বাহুল্য, তাঁর নির্দেশমতো লেখাটি দিয়েছিলাম।
কয়েক বছর আগে স্যারের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল, সেখানে একজন ছাত্র হিসেবে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলার জন্য নির্মাতাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। আমি তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু বলেছিলাম। তিনি ফোন করে শিক্ষকের মতোই বলেছিলেন, ‘তোমার বলাটি ভালো হয়েছে, রবি
কয়েক বছর আগে আমার একটি রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম প্রকাশনা উৎসবে তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করানোর খুব ইচ্ছা ছিল। তাঁকে ফোন করে আমার বাসনাটি জানালাম। তিনি অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি তো দেশের বাইরে যাচ্ছি। এবার সম্ভব হলো না, অন্য সময় বলো।’ এই ‘অন্য সময়’ আর পাওয়া গেল না। নানাবিধ ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি শিল্প-সংস্কৃতিজগতের খবর সবই রাখতেন। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক প্রতিষ্ঠিত ‘শিল্পীর পাশে’ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আমিও সভায় উপস্থিত থাকতাম। লক্ষ করতাম, অখ্যাত, বিখ্যাত সব শিল্পীরই তিনি খবর রাখতেন।
গত বছর ‘শিল্পীর পাশে’ ফাউন্ডেশনের তহবিল সংগ্রহের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে আমরা অনেকেই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছিলাম। কিন্তু সভাপতি হিসেবে তিনি সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। বক্তব্য শেষে উপস্থিত শিল্পীদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে ধন্যবাদ জানাতেও ভোলেননি। এমন সৌজন্যবোধ তাঁর মতো অবস্থানে থাকা একজন ব্যস্ত মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি দেখা যায় না।
- কয়েক বছর আগে একটি বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে রাজি করানো হয়েছিল অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করার জন্য। অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বিদেশিও ছিলেন। স্যার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে বাংলা গানের একটি পরিচিতি তুলে ধরলেন। অনুষ্ঠানে আমি, ফাহমিদা এবং সম্ভবত অদিতি—আমরা গান পরিবেশন করেছিলাম। তিনি পুরো অনুষ্ঠানে মঞ্চে বসে থেকে আমাদের প্রত্যেকের গানের প্রারম্ভে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমাকে তাঁর ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করতেও ভুললেন না। অনুষ্ঠান শেষে রাতের খাবারের ব্যবস্থাও ছিল। তিনি আমাদের টেবিলে বসেই খেলেন, সবারই প্রশংসা করলেন—তাঁর এই অকৃত্রিম স্নেহ ভোলার নয়।
তাঁর মতো একজন প্রজ্ঞাবান অভিভাবক, একজন নিপাট সজ্জন আবার কবে পাওয়া যাবে, কে জানে।
0 Comments: