জাতি যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে শুরু করেছিল তখনই হঠাৎ করে আঘাত এসেছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বে যেহেতু এর প্রভাব, স্বাভাবিকভাবেই এই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। করোনা চলা অবস্থায় দেশের অর্থনীতির চাকা যেন গতিশীল ও সুরক্ষিত থাকে মানুষকে একেবারে ঘরে বন্দি না করে সীমিত আকারে জরুরি কিছু কিছু কাজ চালানোর উদ্যোগের কথাও তিনি জানান।
ক্ষুদ্রশিল্প ও হাট-বাজার চালু করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে কিছু জিনিস উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। মানুষকে সুরক্ষিত রেখে, মানুষের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিয়ে অন্যান্য শিল্প-কারখানাও পরিচালিত হতে পারে। ব্যবসার জন্য যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের দুই মাসের সুদ স্থগিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, ১০ টাকায় চাল কেনার জন্য আরও ৫০ লাখ রেশন কার্ড সুবিধা দেয়া হবে। যাদের আয়-উপার্জনের পথ নেই তাদের ঈদের আগে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। তিনি আবারও কৃষির ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এবার ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হবে। আশা করি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে খাবারের সমস্যা হবে না।’ কৃষির মতো তিনি পোল্ট্রি এবং দুগ্ধশিল্প রক্ষারও পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে ২৭ এপ্রিল একইভাবে গণভবন থেকে রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি ও ত্রাণ বিতরণ নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করার সময় সকলস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মহামারির প্রাদুর্ভাব দূর হওয়ার পর খুলবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য তিনি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে চার দফা পৃথক ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ৪৮টি জেলার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন।
তবে এ কথা ঠিক যে, স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর সৃষ্ট বিপুল চাপ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে নজিরবিহীন লকডাউন ও যোগাযোগ স্থবিরতা বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আমরা জানি করোনা মহামারিতে গত ২৬ মার্চ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ক্রমাগত আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এদেশে লকডাউনের ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ যেমন সংকটে পড়েছে, তেমনি সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও হুমকির মুখে রয়েছে।
আইএমএফ ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরুর আভাস দিয়েছে। আর বলছে, মন্দা প্রলম্বিত হলে বিশ্বে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিপুল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব এই প্রথম এমন মহামন্দা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। তবে করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কী ধরনের বা কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা এখন পরিষ্কার।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে করা হচ্ছে, এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। দীর্ঘ ছুটি বা কার্যত লকডাউনের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ এবং পরিবহন সেবা ব্যাহত হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস এবং সরবরাহ চেনে সমস্যা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে। এর ফলে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এসবই হচ্ছে মহামারির বাস্তবতা। কিন্তু আমরা এদেশের অর্থনীতিতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।
৩.
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের আগে এপ্রিল (২০২০) মাসের প্রথম সপ্তাহে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছিল, করোনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারের আর্থিক প্রণোদনা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে বলে সংস্থাটি ভেবেছে।
৩ এপ্রিল এডিবির আউটলুক ২০২০-এ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধি কমলেও এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশে। এছাড়া আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি আবার ৮ শতাংশ হবে। এদিকে এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে বলে জানিয়েছে এডিবি। মহামারির কারণে যেখানে গত বছর গড়ে ৫.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সেখানে ২০২০ সালে এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল সরকার। তবে গবেষকদের আশা, মহামারি শেষ হলে বিদেশে কর্মী প্রেরণ ও প্রবাসীদের কর্মে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। তৈরি পোশাকের রফতানির বড় বাজারগুলোতে চাহিদা বাড়লে ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি কিছুটা এগিয়ে ৮ শতাংশে উঠতে পারে। আর কৃষি উৎপাদন তো আছেই।
গত ৫ এপ্রিল করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্যাকেজ ঘোষণাকালে তিনি বলেছেন- তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি- এভাবে ভাগ করে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চারটি কার্যক্রম নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। এই চারটি কার্যক্রম হবে- সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা, আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রফতানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি গৃহহীনদের জন্য ঘর ও খাবারের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর ৫ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে তিনি নতুন চারটি প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টর, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ সুবিধা, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফিন্যান্স স্কিম চালুর ঘোষণা দেন।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ যে এদেশের অর্থনীতিকে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে তার কারণ হলো এই বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ। এই প্রণোদনা প্যাকেজে এদেশের মানুষের আর্থসামাজিক গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে। আর ঘোষিত আর্থিক সহায়তা প্যাকেজসমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন হলে আমাদের অর্থনীতি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবে এবং আমরা কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব।
উপরন্তু রফতানি খাতের পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের প্রতিও বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সকলকে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখাই হলো আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।
৪.
২০২০ সালের শুরু থেকে করোনার ধাক্কায় পৃথিবীর চিত্রই বদলে গেছে। ফলে নতুন এক অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। গবেষকদের মতে, করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। যেমন, সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের ওপর যে অতিনির্ভরতা গড়ে উঠেছে, তা থেকে এবার সকলেই বেরিয়ে আসতে চাইবে। সেক্ষেত্রে একটি বড় সুযোগ আসতে পারে ভারত, বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের। এ জন্য দরকার সুপরিকল্পিত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রস্তুতি নেয়া।
বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ২০ শতাংশ মানুষের জীবিকার উৎস ভ্রমণ ও পর্যটন। যে দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের গুরুত্ব যত বেশি, সেখানে আঘাতের তীব্রতাও হবে ততটাই। কৃষিনির্ভর আমাদের দেশ এ হিসাবের বাইরে থাকবে। মহামারির কারণে অর্থনৈতিক মন্দার চাপে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ শতাংশ শিল্প সংস্থা দেউলিয়া হতে পারে, তার সঙ্গে থাকবে অসংগঠিত বা ক্ষুদ্রশিল্পে কাজ হারানোর ভয়াবহ ভবিতব্য। এ কথা সত্য, কৃষি উৎপাদন ছাড়া স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সব খাতের উৎপাদন কার্যক্রম। শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখতে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সরকারকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে।
আগেই বলা হয়েছে, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে দুই শতাংশ সুদে বাংলাদেশ সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। সুখের খবর হলো- পোশাক খাতের বড় বড় ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। তারা ক্রয়াদেশগুলো বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। শিপমেন্টের অপেক্ষায় থাকা পণ্য নেয়ার বিষয়েও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। ক্রেতাদের এমন সিদ্ধান্তের ফলে করোনার প্রভাবে যে ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিলের কথা বলা হচ্ছিল, এখন সেই পরিমাণ কমে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বলে থাকেন, বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে আশ্চর্য এক সহনশীল ক্ষমতা এবং ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যে জাতি মাত্র ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে পারে- সেই জাতিকে কেউ কখনও দাবিয়ে রাখতে পারবে না, এটা জাতির পিতা নিজেই বলে গেছেন। কাজেই মহামারিতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট দূর করার জন্য জাতির পিতার সেই অমরবাণী বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে; ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তাঁর নেতৃত্বে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ভবিষ্যতে মানুষের আর কোনো সমস্যা থাকবে না। সকলের কষ্ট লাঘব করাটাই বর্তমান সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
nice
ReplyDeletewww.itsalyssagermaine.com
Nice
ReplyDeleteGreat.
ReplyDeletePlease follow my son's blog too